যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় দুই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে মিয়ানমার। একদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে কোনও পদক্ষেপ ঠেকিয়ে দিতে তারা দুই মিত্র শক্তি চীন আর রাশিয়াকে ব্যবহার করতে চাইছে। অন্যদিকে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় রাখাইনের অর্থনীতিকে আরও চাঙ্গা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সে দেশের শীর্ষ সংবাদমাধ্যম মিয়ানমার টাইমস-এর এক খবর থেকে এসব কথা জানা গেছে। 
রাখাইনে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাবিরোধী তৎপরতায় এরইমধ্যে সে দেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনেছে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালই একই অভিযোগ এনেছে। সংস্থাগুলো স্যাটেলাইট ইমেজ আর ভিডিওচিত্রে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অপকর্মের নজির তুলে এনেছে। এমন বাস্তবতায় রয়টার্স-এর সোমবারের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভূক্ত দেশগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। ওই পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কূটনীতিকদের উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানায়, সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা, বৌদ্ধনেতাদের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাসহ খোদ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার পরিকল্পনা রয়েছে আলোচনার টেবিলে।ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা ১৬ অক্টোবর আলোচনায় বসতে পারেন। মিয়ানমার টাইমস-এর মঙ্গলবারের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে কিছু জানতে না পারলেও বৃহৎ অর্থনীতির উপর আঘাত আসার আশঙ্কা করছে মিয়ানমার। মিয়ানমার মনে করছে, নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে, যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে, মার্কিনিদের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রে থাকা মিয়ানমারের সম্পদও বাজেয়াপ্ত করা হতে পারে। ২০১২ সালে ইইউ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর আবারও ৬ বছর পর সেই পরিণতি হতে পারে বলে মনে করছে দেশটি।

রোহিঙ্গা সংকটমিয়ানমার টাইমস-এর ওই প্রতিবেদন বলছে, পশ্চিমাদের পদক্ষেপের আগেই নিষেধাজ্ঞাসহ নানামুখী তৎপরতার বিপরীতে নিজেদের সুরক্ষার প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে নেপিডো। কূটনৈতিক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে পশ্চিমাদের যে কোনও ধরনের তৎপরতা ঠেকাতে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে তারা আলোচনা করছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে এই দুই দেশই তাদের সমর্থন দিয়েছিলো।

ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, কূটনৈতিক পদক্ষেপের পাশাপাশি পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কায় ডি-ফ্যাক্টো সরকারের পক্ষ থেকে রাখাইনের অর্থনীতি চাঙ্গা করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ৭ অক্টোবর মিয়ানমারের ব্যবসায়ীদের সংগঠন ইউএমএফসিসিআই এর এক সভায় ইয়াংগুন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ইউ ফিয়ো সিন থেইন রাখাইনের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এগিয়ে আসতে বলেছেন।

মিয়ানমার টাইমসকে তিনি বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যে প্রতিটি সেক্টরে অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রয়োজন। আমি সবাইকে বলেছি যে যেভাবে পারেন অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সহায়তা করুন।’ তবে ঠিক কেমন সহায়তা চাইছেন সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি তিনি।

বর্তমাসে কিয়াকফুয়ে অর্থনৈতিক বিশেষ অঞ্চল করতে একটি চুক্তির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে চীন। এছাড়া সেখানে একটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। গত সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী এই বিশেষ অঞ্চলে ১৫ শতাংশ অংশীদারত্ব ছিলো চীনের। এবার সেটি ৩০ শতাংশের নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে চীন।

রোহিঙ্গা সংকটভারতও রাখাইনে বেশ সক্রিয়। কালাদান মাল্টি-মডেল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পে ভারতের পূর্বাঞ্চলের কলকাতার সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে রাখাইনের সিতে সমুদ্রবন্দরের সংযোগ হবে। ভারতীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সিতে জেটি ও পালেতওয়া মেরিন টার্মিনাল নির্মাণের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলো। সেই তুলনায় মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের বড় কোনও বিনিয়োগের পরিকল্পনা নেই। মিয়ানমার ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাঝেও একটি বিনিয়োগ চুক্তি আলোচনায় রয়েছে।

মিয়ানমারের ইনভেস্টমেন্ট কমিশন সচিব ইউ অং নাইং বলেছেন, তাদের সরকারের প্রথম কাজ হবে রাখাইনে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগে আরও আকৃষ্ট করা। তিনি বলেন, সহিংসতার এলাকায় স্থানীয় বা বিদেশি কোনও সরাসরি বিনিয়োগ নেই। চলতি বছর মংডুতে শুরু হতে যাওয়া সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসতে হচ্ছে। কারণ ব্যবসার জন্য সেখানে পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই।

আগস্টে রাখাইনের অ্যাডভাসরি কমিশনের জমা দেওয়া চূড়ান্ত রিপোর্টেও জাতিসংঘ সরকারকে অবকাঠামো নির্মাণে তাগিদ দিয়েছেন। রাস্তা নির্মাণ, বিদ্যুৎ সুবিধার পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানি ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা দেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছে তারা।

.

রোহিঙ্গা সংকটউল্লেখ্য, সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে দেশ শাসন থেকে সরে আসার পর ২০১২ সালে মিয়ানমারের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ইইউ। নব্বইয়ের দশক থেকে চলে আসা অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা এখনও রয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপর থেকে বেশিরভাগ নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা রেখেছে। তবে আবারও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বৃহৎ পরিসরে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে প্রশাসনে তেমন সমর্থন নেই। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, এক মাস আগেও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি আলোচনায় ছিল না। তবে ঘরবাড়ি ছেড়ে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাওয়া পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের চাপে ফেলেছে। পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার পরিকল্পনায় এই চাপ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছে রয়টার্স।